পাকিস্তানের তিনটি বড় রাজনৈতিক দল যা-ই দাবি করুক না কেন, সত্য এই যে ক্ষমতাসীন নুন লীগ, জোটসঙ্গী পিপলস পার্টি এবং বিরোধী দল তেহরিক-ই-ইনসাফ — এদের সবারই সংগঠনগত অবস্থা দুর্বল। না শাসক দলগুলোর পাঞ্জাবে কোনো কার্যকর সংগঠন আছে, না বিরোধী দলে কোনো তৃণমূল কাঠামো। গত নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনো বড় পরিবর্তন আসেনি, তাই বলা যায় যে তেহরিক-ই-ইনসাফের ভোট এখনও বিদ্যমান, কিন্তু কোনো কার্যকর শৃঙ্খলা না থাকার কারণে তাদের রাস্তার শক্তি শেষ হয়ে গেছে।
নুন লীগকে অতীতের কয়েক বছরে যে ধাক্কাগুলো খেতে হয়েছে, তাতে তাদের সংগঠন ও স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো ভেঙে গেছে এবং এখন নুন লীগের সংগঠনও নামমাত্র, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। পিপলস পার্টির সংগঠনও শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, তারা ভোট ব্যাংককে সক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে না, প্রয়োজনে রাস্তাও গরম করতে পারে না। অতীতে এই তিনটি দলই বিভিন্ন সময়ে কার্যকর সংগঠন রাখত এবং নিজেদের দলীয় সংগঠনের মাধ্যমে নির্বাচন জিতত, কিন্তু সত্য হলো — আজকের দিনে এই তিনটি দল শুধু সংবাদপত্র, টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে টিকে আছে। নেতৃত্ব ও ভোটারের মধ্যে কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই এবং এমন কোনো কাঠামোও নেই যা এই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
বিরোধীরা যেহেতু কঠিন অবস্থায় আছে, তাই তাদের মনোযোগ সংগঠনের দিকে দেওয়া সম্ভব নয় — তাদের প্রধান অগ্রাধিকার এখন বেঁচে থাকা (Survival)। পিপলস পার্টিও জানে যে পাঞ্জাবে তাদের পায়ের নিচের জমি সরে গেছে, কিন্তু তারা এমন কোনো ফর্মুলা, নেতা বা বয়ান পাচ্ছে না যার মাধ্যমে তারা আবার পাঞ্জাবে পা জমাতে পারে। নুন লীগকে নির্বাচনী ও সংগঠনগত দিক থেকে পাঞ্জাবে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ধরা হয়। নুন লীগের অভ্যন্তরীণ বৈঠকগুলোতে নিজেদের দুর্বল সংগঠন, ভোট ব্যাংকের ঘাটতি ও বয়ান নিয়ে পরামর্শ চলতে থাকে।
নুন লীগ অনেক দোদুল্যমানতার পর শেষ পর্যন্ত মকতাদির (Establishment)-এর সেই বয়ানকে পুরোপুরি মেনে নিয়েছে যে তেহরিক-ই-ইনসাফের রাজনীতি দেশকে ক্ষতি করছে, বরং এই রাজনীতির পেছনে বিদেশি পরিকল্পনা রয়েছে যার উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে ভেঙে ফেলা। শোনা যায়, শুরুতে অনেক নুন লীগার এই বয়ানকে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত ছিল এবং তারা নিজেদের গোপন বৈঠকে বলত যে তেহরিক-ই-ইনসাফকে দেয়ালের সঙ্গে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়, কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এবং তেহরিক-ই-ইনসাফের সঙ্গে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় এখন নুন লীগাররা সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই বিষয়ে একমত হয়ে গেছে এবং তারা বিশ্বাসী হয়েছে যে তেহরিক-ই-ইনসাফ ৯ মে বিচারপতি ও কয়েকজন জেনারেলের সঙ্গে মিলে বিপ্লব আনার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
এমনকি এখন বলা হচ্ছে যে সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ও তেহরিক-ই-ইনসাফের পরিকল্পনা ছিল অডিয়ালা জেল ভেঙে আগে ইমরান খানকে মুক্ত করা হবে, তারপর জি.এইচ.কিউ. (GHQ)-তে আক্রমণ করা হবে। এই বয়ান গ্রহণ করার পর নুন লীগের পরিকল্পনা এখন স্পষ্ট — নিকট ভবিষ্যতে তেহরিক-ই-ইনসাফের সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতা বা ইমরান খানের মুক্তির কোনো সম্ভাবনাই নেই।
এখন নুন লীগের জানা হয়ে গেছে যে পাঞ্জাবের ময়দান তাদের রাজনীতির জন্য উন্মুক্ত, তেহরিক-ই-ইনসাফের কোনো ক্ষমা নেই; তাই নুন লীগ পিপলস পার্টিকে এই প্রদেশে কোনো স্থান দিতে রাজি নয়। কিন্তু নুন লীগের সমস্যা হলো — কীভাবে আবার নুন লীগের ভেতর প্রাণ ফেরানো যাবে, কীভাবে দলের সংগঠন দাঁড় করানো যাবে, আর নিজের ভোট ব্যাংক কীভাবে পুনর্গঠন করা যাবে।
নুন লীগের বড়দের অনেক বৈঠক ও পরামর্শ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে নুন লীগ এখন রাজনৈতিক দাবার আসরে গুটি চালাতে শুরু করেছে। ঠিক হয়েছে যে প্রদেশে ধাপে ধাপে স্থানীয় সরকার (লক্যাল গভর্নমেন্ট) নির্বাচন করানো হবে, এবং তারপর জেনারেল জিয়া, জেনারেল আয়ুব ও জেনারেল মুশাররফের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করা হবে — এক লক্ষের বেশি নির্বাচিত স্থানীয় প্রধান নুন লীগের নতুন রাজনৈতিক নার্সারি হয়ে উঠবে।
নির্বাচন করানো হবে কি হবে না — এ নিয়ে নুন লীগের বড়দের মতভেদ ছিল। এক পক্ষের মত ছিল, পাঁচ বছর উন্নয়নমূলক কাজ চালানো হোক এবং কোনো নির্বাচনী ঝুঁকি না নেওয়া হোক। অন্য পক্ষ বলেছিল, উন্নয়নের কৃতিত্ব তখনই পাওয়া যাবে যখন স্থানীয় সরকারে নুন লীগের প্রতিনিধিরা থাকবে। মনে হচ্ছে এখন ঠিক হয়েছে যে নির্বাচনের দিকে অবশ্যই এগোনো হবে — তবে সতর্কতার সঙ্গে।
এই পরামর্শমূলক বৈঠকগুলোতে এই প্রশ্নও উঠেছিল যে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে রাজনীতি আবার জীবিত হবে, আর যখন রাজনীতি জীবিত হবে, তখন তেহরিক-ই-ইনসাফের মৃত সংগঠনের শরীরে আবার প্রাণ ফিরে আসবে। এমন না হয় যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নতুন রাজনৈতিক হাঙ্গামার জন্ম দেয়। এই আশঙ্কায় ভারতের মতো ধাপে ধাপে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে — প্রথমে সবচেয়ে অরাজনৈতিক ও নিরাপদ জেলাগুলোতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে।
নুন লীগ, তেহরিক-ই-ইনসাফ ও পিপলস পার্টির প্রার্থীদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়ে একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য যৌথ সাফল্যের ফর্মুলা গ্রহণ করা হয়েছে — অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিয়ন কাউন্সিলে ৯ জন সদস্য নির্বাচিত হবে এবং তারা পরে নিজেদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করবে। আপাতত এই স্থানীয় সরকার আইনগুলোর খুঁটিনাটি ঠিক করা হচ্ছে এবং মনে হচ্ছে নুন লীগ খালি মাঠ দেখে তাতে নেমে পড়তে যাচ্ছে, যেখানে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়— তিন স্থানেই তারাই থাকবে।
নুন লীগের সূচনা হয়েছিল ১৯৭৯, ১৯৮৩ সালের অদলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং পরে ১৯৮৫ সালের অদলীয় জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।
আশা করা হচ্ছে, নভেম্বরের পর থেকে দেশে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেখা যেতে শুরু করবে। এটা তো নির্ধারিত যে বর্তমান সেটআপে তেহরিক-ই-ইনসাফের জন্য কোনো স্থান নেই। এটাও প্রায় নিশ্চিত যে সরকারকে জোটসঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে চালানো হবে। এটা-ও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে অর্থনীতি উন্নত করার দিকে মনোযোগ বাড়বে।
এই নির্ধারিত বিষয়ের বাইরে এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো এখনও স্থির হয়নি এবং সেগুলো নিয়ে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ রয়েছে। বর্তমান সেটআপ কি আগামী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মরিয়ম নওয়াজের নাম চূড়ান্ত করেছে কি না — সেটাও অনিশ্চিত। বিলাওয়াল ভুট্টোও একই পদে প্রার্থী, এবং সরকারের ভেতরে বসে থাকা অনেক মুখও এর আকাঙ্ক্ষী।
যাই হোক, এটা এখনো স্থির হওয়া বাকি যে সেটআপ ভবিষ্যতের জন্য কাকে বেছে নেবে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইমরান খানের জীবন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। এটাও কোনো একসময় নির্ধারণ করতে হবে — ইমরান খানকে কি একইভাবে জেলে রেখে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বজায় রাখা হবে, নাকি এই সমস্যার সমাধানের জন্য কোনো পথ খোঁজা হবে?
পিপলস পার্টি যদিও মিশ্র সরকারের অংশীদার, কিন্তু তারা কোনো মন্ত্রণালয় নেয়নি — এটি একটি অপ্রত্যাশিত ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিনিয়ত উত্তেজনার আশঙ্কা রয়েছে। এটা ঠিক করতে হবে যে এই ব্যবস্থা কি এভাবেই উত্থান-পতনের মধ্যে থাকবে, নাকি এরও কোনো সমাধান বের করা হবে।
রাজনীতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সম্পর্কেও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে — সীমিত রাজনীতি ও স্বাধীনতার পরিবেশে কি দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি বজায় রাখা সম্ভব হবে? এবং এমন প্রশাসনিক ও বিচারিক কাঠামোর উপস্থিতিতে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী বা বন্ধু রাষ্ট্র কি পাকিস্তানে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করবে?
নভেম্বর পেরোলে, এই মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর পর্যালোচনা করে তাদের সম্ভাব্য উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। যদি তা করা যায়, তবে রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সফল হবে।